যুক্তরাষ্ট্র
ইমিগ্র্যান্ট ডিপোর্টেশনে নতুন ফাঁদ : অবৈধদের দিনে হাজার ডলার জরিমানা

কষ্ট করে উপার্জন করে আমেরিকান সরকারকে ট্যাক্স প্রদানই অভিসাপ হিসেবে হাজির হলো। ফাঁদে পড়লেন প্রবাসীরা। কারণ, অবৈধ ইমিগ্রান্ট প্রশ্নে আইআরএস ও আইস পুলিশের নাটকীয় সমঝোতা হয়েছে। উদ্দেশ্য অবৈধ ইমিগ্রান্টদের তথ্য সংগ্রহ। আর এই তথ্যের ভিত্তিতে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির আইস পুলিশ অভিযান চালাবে। ডিপোর্ট করবে আটকদের।
অবৈধ ইমিগ্রান্টদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডিপোর্ট করার উদ্দেশে ‘আইআরএস’ অবৈধদের ব্যাপারে তাদের তথ্য দিয়ে ‘আইস’কে সহায়তা করতে সম্মত হয়েছে এবং উভয় সংস্থার মধ্যে এ মর্মে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। এছাড়া ডিপোর্টেশন এড়িয়ে কেউ যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করলে প্রতিদিন তাকে ৯৯৮ ডলার পর্যন্ত জরিমানা করা হতে পারে। জরিমানার পরিশোধ না করলে সংশ্লিষ্টের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবে।
ট্রাম্প প্রশাসন পাঁচ বছর পর্যন্ত জরিমানা প্রয়োগের পরিকল্পনা করছে। যার ফলে ১ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি জরিমানা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনাল রেভিনিউ সার্ভিসেস বা আইআরএস ও ইউএস ইমিগ্রেশন এন্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট গত ৭ এপ্রিল সোমবার অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ইমিগ্রান্টদের ট্যাক্স তথ্য শেয়ার করার এক নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
এই চুক্তির মাধ্যমে ইমিগ্রেশন এন্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট অবৈধ অভিবাসীদের নাম এবং ঠিকানা আইআরএস-এর কাছে সংগ্রহ করবে এবং অবৈধদের ডিপোর্ট করবে। চুক্তিটি ৭ এপ্রিল সোমবার একটি মেমোরান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং আকারে স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং তা ফেডারেল আদালতের নথিতে পাওয়া গেছে। নতুন এই চুক্তির লক্ষ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত নিরাপত্তা বাড়ানো এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি বাস্তবায়ন করা।
ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, এই পদক্ষেপটি অবৈধ ইমিগ্রান্টদের শনাক্তকরণ এবং তাদের ডিপোর্টেশনে সাহায্য করবে। বিশেষত, যারা অন্যের পরিচয় ব্যবহার করে সেবা গ্রহণ করছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্দেশ্য রয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতির কারণে অনেক অবৈধ অভিবাসী এখন ট্যাক্স দাখিল করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উঠেছে। তাদের উদ্বেগ, ইন্টারনাল রেভেনিউ সার্ভিস (আইআরএস) তাদের ব্যক্তিগত তথ্য সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে পৌঁছলে তা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন আইন বাস্তবায়নের নীতিমালা, বিশেষ করে ট্যাক্স দাতার তথ্যের অপব্যবহার, অনেক অবৈধ অভিবাসীকে ভয় সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি তাদের ট্যাক্স দাখিলের অনীহা সৃষ্টি করেছে। অবৈধ ইমিগ্রান্টরা অনেক পাবলিক সুবিধার আওতার বাইরে থাকলেও তারা রাষ্ট্রীয় ও কেন্দ্রীয় কর রাজস্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ফলে মার্কিন অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে।
প্রতি বছর অবৈধ অভিবাসীরা বিলিয়ন ডলার ট্যাক্স প্রদান করে, কিন্তু বর্তমানে ট্রাম্প প্রশাসন আইআরএসকে ব্যবহার করে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার এবং বহিষ্কারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যা ট্যাক্স দাখিলের ক্ষেত্রে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এর ফলে, ফেডারেল সরকারের জন্য যে ট্যাক্স রাজস্ব একাধিক বছর ধরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হারানোর ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে, আইআরএস ইতিমধ্যে ২০২৪ সালের তুলনায় ১০ভাগ কম ট্যাক্স সংগ্রহের পূর্বাভাস দিয়েছে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে।
সম্প্রতি এআইসি প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি (ডিএইচএস) আইআরএসকে ৭ লাখ ট্যাক্সদাতার বাড়ির ঠিকানা সরবরাহ করতে অনুরোধ করেছে, যারা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে। আইআরএস প্রথমে এই তথ্য প্রদানে অস্বীকার করেছিল, তবে ২২ মার্চের এক রিপোর্টে জানা গেছে, তারা ডিএইচএসের কাছে এই তথ্য সরবরাহের বিষয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর কাছাকাছি রয়েছে। এর ফলে আইআরএস ট্যাক্স তথ্য যাচাই করে ডিএইচএসের দেওয়া চূড়ান্ত বহিষ্কারের আদেশের সঙ্গে মিলিয়ে এর ব্যবহার করতে পারবে, যা ট্যাক্স ও অভিবাসন প্রবক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কংগ্রেস সদস্য ডেবি ওয়াসারম্যান শুল্টজ এবং আরও ৬০ জন কংগ্রেস সদস্য একত্রে একটি চিঠি পাঠিয়ে আইআরএসকে আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে তারা অবৈধ অভিবাসী পরিবারগুলোর ট্যাক্স তথ্য ব্যবহারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, যারা কোনো অপরাধমূলক ইতিহাস ছাড়া ট্যাক্স প্রদান করে।
অবৈধ ইমিগ্রান্টদের মধ্যে অনেকেই যারা সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর (এসএসএন) পান না, তারা ইনডিভিজুয়াল ট্যাক্সপেয়ার আইডেনটিফিকেশন নম্বর (আইটিআইএন) ব্যবহার করে ট্যাক্স দাখিল করেন। ইনস্টিটিউট অন ট্যাক্সেশন অ্যান্ড ইকোনমিক পলিসি (আইটিইপির) তথ্য অনুযায়ী, ৫০ ভাগ থেকে ৭৫ভাগ অবৈধ অভিবাসী পরিবার আইটিআইএন ব্যবহার করে ট্যাক্স ফাইল করেন। ২০২৩ সালে অবৈধ অভিবাসী পরিবারগুলো মোট ৮৯.৮ বিলিয়ন ডলার ট্যাক্স প্রদান করেছে, যার মধ্যে ৫৫.৮ বিলিয়ন ডলার ফেডারেল ইনকাম ট্যাক্স এবং ৩৩.৯ বিলিয়ন ডলার রাজ্য ও স্থানীয় ট্যাক্সে গেছে। তাদের ট্যাক্স অবদান আমেরিকার পাবলিক সার্ভিস এবং বিভিন্ন প্রোগ্রাম যেমন স্কুল, স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামো এবং সামাজিক কর্মসূচিতে সহায়তা করেছে।
এদিকে বর্তমান প্রশাসনের পদক্ষেপগুলো ট্যাক্স তথ্যকে অভিবাসন প্রয়োগের জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে, যা অনেকের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পদক্ষেপগুলোর ফলে অবৈধ অভিবাসীরা ট্যাক্স দাখিল করতে ভয় পেতে পারেন, তবে এতে তাদের আর্থিক চাপ এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্নে আরো খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।
দীর্ঘমেয়াদে এই ধরনের আচরণের ক্ষতি সরকার ও সমাজের জন্য হতে পারে, কারণ অবৈধ অভিবাসীদের ট্যাক্স অবদান আমেরিকার অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৩ সালের ট্যাক্স ডে এবং ভবিষ্যতের প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলোর ফলে, আমেরিকান অভিবাসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যে হুমকি তৈরি হচ্ছে, তা দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোর উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতির কারণে অবৈধ ইমিগ্রান্টদের মধ্যে ট্যাক্স দাখিলের ভয় ও অনীহা সৃষ্টি হয়েছে, যা তাদের কর প্রদানের প্রবণতা কমিয়ে দিয়েছে। এটি শুধু অভিবাসীদের জন্য একটি সমস্যা নয়, বরং দেশের অর্থনীতির ওপরও প্রভাব ফেলছে। কারণ তারা অনেক সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেও, কর প্রদান করে অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। এর ফলে, অভিবাসন আইন ও কর নীতির মধ্যে সংঘাত দেখা দিয়েছে, যা অর্থনৈতিক অবকাঠামো এবং সামাজিক উন্নয়নেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
এটি স্পষ্ট যে, যদি অভিবাসীদের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার নিশ্চয়তা না দেওয়া হয়, তবে তারা ট্যাক্স দাখিল করতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়বে, যা সরকারের রাজস্ব কমাবে এবং তাদের বৈধতার প্রক্রিয়াকে আরো জটিল করে তুলবে। তাই অভিবাসন নীতি এবং কর আইন সঠিকভাবে সমন্বয় করতে হবে, যাতে অভিবাসীরা তাদের দায়িত্ব পালনে উৎসাহী হয় এবং সরকার তাদের অবদান গ্রহণ করতে পারে। এটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং ন্যায়বিচারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকা না ছাড়লে অবৈধ ইমিগ্রান্টদের দৈনিক ৯৯৮ ডলার জরিমানা
ট্রাম্প প্রশাসনের নির্বাসন আদেশের পরও অবৈধ ইমিগ্রান্টদের কেউ আমেরিকায় থাকলে প্রতিদিন তাকে ৯৯৮ ডলার পর্যন্ত জরিমানা করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। জরিমানার অর্থ না দিলে বাজেয়াপ্ত করা হবে সম্পত্তি। নথি বিশ্লেষণের পর বার্তা সংস্থা রয়টার্স বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে বলে এক প্রতিবেদেন জানানো হয়েছে। ১৯৯৬ সালের একটি আইনে এই জরিমানার বিধান আছে। ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে প্রথমবারের মতো কার্যকর করা হয়েছিল এ আইন। ট্রাম্প প্রশাসন পাঁচ বছর পর্যন্ত জরিমানা প্রয়োগের পরিকল্পনা করছে, যার ফলে ১ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি জরিমানা হতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানিয়েছেন, ট্রাম্প প্রশাসন পাঁচ বছর পর্যন্ত জরিমানা প্রয়োগের পরিকল্পনা করছে, যার ফলে ১ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি জরিমানা হতে পারে।